দেওয়াল চিত্রকর্মের বাণী এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে তাঁদের আশা-আকাঙ্খার যথার্থ প্রতিফলন

মোরা আকাশের মতো বাধাহীন

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম

যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ

নোবেলবিজয়ী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কিছু মানুষ স্বপ্ন দেখে আর কিছু মানুষ তাঁদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়

এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা জনাব জামাল উদ্দীন আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী রোজী আহমেদ দ্বিতীয় দলে অন্তর্ভুক্ত।  জনাব আহমেদ নিজের প্রচেষ্টায় কীর্তিমান, আপন নিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রম আর আত্মবিশ্বাসের জোরে তিনি পেশাগত জীবনে সাফল্যের শীর্ষে অবস্থান করেন।  মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি বাবা ডাঃ ফজলুল করিমকে হারান।  তবে সৌভাগ্যক্রমে তাঁর মা গুলতাজ বেগম দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মহিলা ছিলেন, যিনি সন্তানদের লেখাপড়ায় বিশেষ গুরুত্ব দিতেন।  তাঁকে ছোটবেলা থেকেই নানা বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে, সেসব তিনি ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হিসেবেই মোকাবেলা করেছেন।  এর পাশাপাশি তারঁ বড়ভাইকে পেয়েছিলেন আদর্শ হিসেবে।  তাঁর বড়ভাই ডাঃ কামালউদ্দীন আহমেদ স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন – তিনি বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ফার্মাকোলজিস্টদের একজন ছিলেন। 

জনাব জামাল উদ্দীন আহমেদ চট্টগ্রামে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষালাভ করেন।  এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।  ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি একজন ছাত্রনেতা ছিলেন।  যদিও ১৯৫১-১৯৫২ সালের সেই উত্তাল রাজনৈতিক সময়ে তিনি ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন, তারপরও তিনি ডিস্টিংশন সহ প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।  বার্মা শেল স্কলারের বৃত্তির জন্য নির্বাচিত হয়ে তিনি চার্টার্ড এ্যাকাউন্টেন্সী পড়াশোনার জন্য লন্ডনে যান।  সেখানে তিনি Peat Marwick Mitchell কোম্পানির ফেলো ছিলেন এবং প্রথম চেষ্টাতেই ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের চ্যার্ডার্ড এ্যাকাউন্টেন্সী পরীক্ষা পাশ করেন।

জনাব আহমেদ বাংলাদেশে (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান) ফিরে চট্টগ্রামে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন।  সরকারী ও বেসরকারী উভয় খাতে তিনি উচ্চতম পর্যায়ে কাজ করেন।  তিনি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভার উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন।  এরপর তিনি বাংলাদেশ সরকারের শিল্পমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।   তিনি চট্টগ্রাম-৪ নির্বাচনী এলাকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।  এখনো পর্যন্ত জনাব আহমেদ চট্টগ্রাম এলাকা থেকে একমাত্র ব্যক্তি যিনি উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করেছেন।

জনাব জামাল উদ্দীন আহমেদ এবং রোজী আহমেদের একটা দীর্ঘমেয়াদী স্বপ্ন ছিল জনাব আহমেদের জন্মস্থান দৌলতপুর গ্রামে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল ও কলেজ স্থাপন করা।  তাঁদের দু’জনের বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল যে একটি জাতির সাফল্য নির্ভর করে মেয়েদের শিক্ষার ওপর।  তাঁদের দুই মেয়ের কাছে তাঁদের একটাই চাওয়া ছিল – তোমরা শিক্ষিত হও, নিজে কিছু করার ক্ষমতা অর্জন করো।  গুলতাজ মেমোরিয়াল স্কুল ও কলেজের ছাত্রীদের কাছেও তাঁদের একই প্রত্যাশা ছিল। 

দুই কন্যার দৃষ্টিতে প্রতিষ্ঠাতাদের অন্তরঙ্গ পরিচিতি

জামাল উদ্দীন আহমেদ (জন্মঃ মার্চ ০১, ১৯৩২; মৃত্যুঃ জানুয়ারী ০৩, ২০১৫)

আমাদের বাবা জনাব জামাল উদ্দীন আহমেদ ছিলেন এক বুদ্ধিদীপ্ত স্বপ্নদ্রষ্টা।   তাঁর মানুষকে আকৃষ্ট করবার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল, নেতৃত্বের গুণ ছিল তার সহজাত, সেই সাথে যুক্ত হয়েছিল জীবনের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে গভীর সচেতনতা।  প্রচুর পড়াশোনা করতেন, লেখালেখিও করেছেন অনেক।  বাগ্মী ছিলেন, মানুষের সাথে যোগাযোগের ক্ষমতা ছিল ঈর্ষণীয়।  নানা বিষয়ে যেমন তাঁর আগ্রহ ছিল, তেমন বহু বিষয় সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞানও ছিল সুগভীর।  বিশ্বের রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল।  ভিন্নমত পোষণকারীদের সাথে আলোচনা করতে সব সময় রাজি ছিলেন, এবং তুমুল বিতর্কে প্রভূত আনন্দ পেতেন।  বন্ধুসুলভ, সহজ স্বভাবের জন্য চট করে তার কাছাকাছি যাওয়া যেত – এই বিষয়টি সবার মনে গভীর রেখাপাত করত।  বিশ্ব অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় রাজনীতি, মানবাধিকার বা আটপৌরে ঘরোয়া বিষয় যাই হোক না কেন, সকল বিষয়ে আলাপচারিতায় তিনি যেমন সমান সচ্ছন্দ ছিলেন, তেমন চট করে যে কোন বিষয় থেকে সম্পূর্ণ অন্য বিষয়ে অবলীলায় আলোচনায় চলে যেতে পারতেন।   ঘরে হোক অথবা বাইরে বক্তৃতা মঞ্চে হোক, তাঁর শ্রোতাদের সাথে যোগসূত্র স্থাপনের একটা সহজাত ক্ষমতা ছিল।  উদারমনা, সদালাপী এবং ব্যঙ্গে তুখোড় এই মানুষটির গভীর রসবোধ ছিল।  কারো সাথে বাক্যালাপের সময় তিনি এতটা আগ্রহ প্রকাশ করতেন যে সেই ব্যক্তির মনে এই বিশ্বাস জন্মাত যে ঘরে তিনিই একমাত্র লোক।  সারাজীবন যেখানে গিয়েছেন, তার মনোগ্রাহী, ঊষ্ণ স্বভাব আর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের গুণে জীবনের সর্বক্ষেত্রে অজস্র মানুষের বন্ধুত্ব লাভ করেছেন।  তিনি ভালো খাবার, সঙ্গীত, ভ্রমণ ভালোবাসতেন, আর প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন তাঁর পরিবারকে।  আমাদের বাবার ধর্মীয় ভক্তি ছিল গভীর, তবে ধর্মপালনের ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত বাস্তবানুগ ছিলেন।  স্বভাবে উদার ছিলেন, মানুষকে বিশ্বাস করতেন, মানুষের সহমর্মী ছিলেন এবং মানুষকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন।  তিনি কঠোর পরিশ্রমে বিশ্বাস করতেন, এবং লোকে নিজ প্রচেষ্টার জীবনে সাফল্য অর্জনের সুযোগ লাভ করুক, এই বিষয়ে তাঁর একটা দায়িত্ববোধ ছিল।  বয়সের ক্রমানুযায়ী পরিবারে দ্বিতীয় হলেও তিনি বৃহত্তর পরিবারর অভিভাবক ছিলেন।  তিনি এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন সগৌরবে, নিজের সম্মান ও ন্যায়বোধ সমুন্নত রেখে।  ব্যক্তিগতভাবে বা সামাজিকভাবে তিনি বরাবার জীবনে নানা চড়া-উৎরাইয়ের মোকাবেলা করেছেন গভীর বিশ্বাস, সততা ও আশাবাদের সাথে।  ইতিবাচক মানসিকতা আর আত্মবিশ্বাস তাঁকে তাঁর চার্টার্ড এ্যাকাউন্টেন্সীর পেশা অতিক্রম করে উচ্চাকাঙ্খী হতে শিখিয়েছিল।  বহুজাতিক তেল কোম্পানির নির্বাহী হিসেবে যাত্রা শুরু করার পর তিনি নিজের পেশাদারী প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন, তারপর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, তারপর বাংলাদেশ সরকারে শিল্পমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন।  এরপর ঠিক করলেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হবেন, তারপর জনহিতকর কাজে আত্মনিবেদিত হন।  জীবদ্দশায় এইসব বিভিন্ন কর্মদায়িত্বে তাঁর সাফল্যের পেছনে ছিল নিজের ধৈর্য, লক্ষ্যে অবিচল থাকার শক্তি এবং চরিত্রের দৃঢ়তা।  নির্ভীক ও সাহসী এই মানুষটি জীবন উপভোগ করেছেন পরিপূর্ণভাবে এবং বিনয়ের সাথে, তবে সেটা করেছেন বিনা অনুশোচনায় এবং নিজের মূল্যবোধের সাথে আপোষ না করে।

রোজী আহমেদ (জন্মঃ এপ্রিল ১৫, ১৯৩৫)

আমাদের মা রোজী আহমেদ ছিলেন আমাদের পরিবারের ধ্রুবতারার মতো, তিনি আমাদের পরিবারের সকল শক্তির সুদৃঢ় ভিত্তি।  আমরা সবাই আমাদের জীবনে য্য কিছু সাফল্য অর্জন ও ভোগ করেছি, তার মূলে রয়েছে পরিবারের প্রতি তাঁর অবিচল দায়বদ্ধতা, নীতিপরায়ণতা, গভীর বিশ্বাস এবং নিরন্তর অনুপ্রেরণা।  তাঁর অনুচ্চারিত লাবণ্যময় শান্তশ্রী আমাদের জীবনের কঠিন কঠিন সময়ে বারবার আমাদের রক্ষা করেছে, শক্তি যুগিয়েছে।   গভীর আত্মবিশ্বাস তাঁর, স্বভাবে চুপচাপ এবং সম্পূর্ণ নির্লোভ এই মানুষটির কারো কাছেই কোন চাওয়া নেই, অথচ জীবনের সামান্যতম প্রাপ্তির জন্য কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।  তাই তিনি আমাদের কাছে আদর্শ।  স্বভাবে তিনি অত্যন্ত বিনয়ী, মিতবাক এবং আত্মীয় ও বন্ধু-অন্ত প্রাণ।  ভেতরে ও বাইরে পরম লাবণ্যময় তিনি, বয়স ৮০ পেরোবার পরও তাঁর সেই লাবণ্য বিন্দুমাত্র ম্লান হয়নি।  প্রিয়তম স্বামী, দুই কন্যা এবং আদরের চার নাতি-নাতনিদের নিঃশর্ত ভালোবাসা ও উৎসাহ তাঁর পরম আশ্রয়ের স্থল।  আমাদের মা প্রচুর পড়াশোনা করেন, তিনি সাহিত্য, সঙ্গীত আর মঞ্চ নাটকের ভক্ত।  ইতিহাস, জীবনী নিয়ে বই পড়তে ভালোবাসেন, শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ।  বহু বছর ধ’রে তিনি বিস্তারিত জার্নাল লিখে যাচ্ছেন।  সেখানে তিনি ছোটবেলা এবং জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সঞ্চিত তথ্যের ভিত্তিতে তার পরিবার সম্বন্ধে লিখেছেন।  তিনি প্রকৃতিপ্রেমী, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারেন।  তিনি অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ও ভক্তিপূর্ণ জীবনযাপন করেছেন।  আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস ও আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ তাঁর সকল শক্তি ও সাহসের উৎস।  আমাদের বাবা-মায়ের সারা পৃথিবী ভ্রমণের সৌভাগ্য হয়েছিল, তবে শিকড়ের প্রতি গভীর টানের কারণে তাঁরা বাংলাদেশেই পাকাপাকিভাবে বাস করেছেন।  আমাদের মায়ের অনুপ্রেরণায় যেমন গুলতাজ মেমোরিয়াল স্কুল ও কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তেমনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি কলেজের ব্যাপারে যেমন নিবেদিতপ্রাণ তেমনি এই বিষয়ে গভীর অনুরাগী।  তাঁর দৃঢ় উৎসাহ, আস্থা ও সমর্থনে এই স্কুলটি মাত্র গুটিকয়েক ছাত্রী আর কয়েকটা শ্রেণিকক্ষ থেকে আজ এত বড় হয়েছে।  এই যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিলনা, তবে আমাদের বাবা-মায়ের ত্যাগ, নিষ্ঠা ও ধৈর্য যেমন এই কলেজ স্থাপনার ভিত্তি ছিল, তেমনি এর রক্ষণেরও মুলমন্ত্র।  আমাদের বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল ছাত্রীরা যেন শিক্ষার মাধ্যমে জীবনে উন্নতি করে, ওদের মনকে প্রসারিত করে আর তার ফলে পরবর্তী প্রজন্মের শ্রীবৃদ্ধির জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে।  এই প্রতিষ্ঠান এবং এর উত্তরোত্তর সাফল্য আমাদের মা এবং আমাদের জন্য বিশাল গৌরব ও সুখের বিষয়।